ইউক্রেন যুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দ্বন্দ্ব: মতদান করা অথবা বিরত থাকা

মার্চ 26 2022

অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত নানা কারণ ইউ এন জি এ বৈঠকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সাম্প্রতিকতম অবস্থানকে প্রভাবিত করেছে কী ভাবে?

এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটি ‘ইউক্রেন সঙ্কট: সংঘর্ষের কারণ এবং গতিপথ’ সিরিজের অন্তর্গত।


ভূমিকা

সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ (ইউ এন জি এ) ইউক্রেনে রাশিয়ার কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মতদানের সাক্ষী থেকেছে। তার মধ্যে এটা খেয়াল করা জরুরি যে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই ভাল বন্ধু হওয়া এবং এর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে (ইউ এন এস সি) মতদান থেকে বিরত থাকা সত্ত্বেও অবস্থান বদলে এ বার রাশিয়ার বিরুদ্ধে মতদান করেছে। অবস্থানের এই পরিবর্তন বিশ্ব সঙ্কটের সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সংবেদনশীল অবস্থাকে তুলে ধরে এবং একই সঙ্গে এটাও দর্শায়, কী ভাবে দেশটি নিজস্ব ভৌগোলিক সীমান্তের বাইরের ঘটনা পরম্পরাতেও অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই নিবন্ধে তাই সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সংবেদনশীল অবস্থান এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের নিরিখে তার কৌশলগত অঙ্ক সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

বিশ্বশক্তিগুলির সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সম্পর্ক: একটি পরিবর্তনশীল সমীকরণ

সৌদি আরব, ইরাক, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সংযুক্ত আরব আমিরশাহির আয়তন ছোট হলেও দেশটি তেল সম্পদ এবং পর্যটন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে তার অবস্থানের দিক থেকে নিজের আয়তনের তুলনায় বেশি শক্তির অধিকারী হয়েছে। বিশেষত সে দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদের মৃত্যুর পরে দেশটি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য তীব্র প্রয়াস চালিয়েছে এবং এমনটা করার জন্য সংশ্লিষ্ট একাধিক শক্তি ও সংঘাতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো বিশ্বশক্তির সঙ্গেও সে নিজেকে সংযুক্ত করেছে।

সৌদি আরব, ইরাক, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সংযুক্ত আরব আমিরশাহির আয়তন ছোট হলেও দেশটি তেল সম্পদ এবং পর্যটন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে তার অবস্থানের দিক থেকে নিজের আয়তনের তুলনায় বেশি শক্তির অধিকারী হয়েছে।

ঐতিহাসিক ভাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কট্টর বন্ধু দেশের ভূমিকা পালন করেছে যা দেশটিকে তেলের বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রদানের আশ্বাস জুগিয়েছে। এই সম্পর্কের ফলে উভয় দেশই নানা ভাবে উপকৃত হয়েছে। এমনকি ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ইজরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পর্ক স্থাপনে সমর্থ হয়েছে, যা এত দিন পর্যন্ত অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছিল।

বিগত দশকে প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনকাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে নিজেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং এক জন তেলের ক্রেতা ও নিরাপত্তাপ্রদানকারীর ভূমিকা থেকে সরে এসে নিজেকে শুধু মাত্র অস্ত্র বিক্রেতার ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে। এর ফলে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তার বৈদেশিক সমীকরণের পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য হয়েছে এবং এমনটা করার জন্য অঞ্চলটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ভারসাম্য বিধান করতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি রাশিয়া এবং চিনের মতো সেই সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে যারা আমেরিকার স্বার্থের প্রতিযোগী।

সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-রাশিয়া সম্পর্ক

তাই বিশেষত রাশিয়ার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে এবং এর ফলে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি পশ্চিম এশিয়ায় / মধ্য প্রাচ্যে রাশিয়ার অন্যতম সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত বেশ কিছু সংঘাতের প্রেক্ষিতে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করতেও শুরু করে। যেমন অনেক বছর যাবৎ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধিতা করার পরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টায় আগ্রহী হয়েছে এবং একই সঙ্গে বিপক্ষ গোষ্ঠীগুলির অস্ত্রায়নের বিরোধিতা করা ও আসাদকে ক্ষমতায় বহাল রাখার মতো একাধিক রুশ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে। বলা হচ্ছে যে, এর বেশির ভাগটাই ঘটেছে অঞ্চলটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তারকে অপরিহার্য করে তোলে।

একই রকম ভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার ক্ষেত্রেও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি রাশিয়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে। সে দেশে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সামরিক প্রধান খলিফা হাফতার এবং সইফ গদ্দাফিকে সমর্থন জুগিয়েছে, যেখানে আমেরিকা অঞ্চলটিতে অন্যান্য ক্ষমতা মধ্যস্থতাকারীকে সমর্থন করে। ২০২০ সালে ইউ এস পেন্টাগনের একটি রিপোর্টে এমনটাও তুলে ধরা হয় যে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সম্ভবত লিবিয়ায় রুশ প্যারামিলিটারি সংস্থা ওয়াগনর গ্রুপের অর্থায়ন করেছে। ওয়াগনর গ্রুপটি বিদ্যমান ইউক্রেন সঙ্কটে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে খুন করার তথাকথিত প্রচেষ্টার জন্য বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে।

অনেক বছর যাবৎ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধিতা করার পরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টায় আগ্রহী হয়েছে এবং একই সঙ্গে বিপক্ষ গোষ্ঠীগুলির অস্ত্রায়নের বিরোধিতা করা ও আসাদকে ক্ষমতায় বহাল রাখার মতো একাধিক রুশ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে।

সর্বোপরি, রাজনৈতিক ভাবে সহযোগিতা ছাড়াও রাশিয়াকে সাহায্য করার নেপথ্যে আমিরশাহি শেখতন্ত্রের বিশেষ অর্থনৈতিক স্বার্থ বর্তমান। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বর্তমানে এক বিশাল সংখ্যক রুশ পর্যটকের গন্তব্য, যা কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিতে এক প্রধান চাহিদা এবং সে দেশে সহজতর আর্থিক আইনের সুবাদে একাধিক রুশ বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু। সন্দেহাতীত ভাবেই ইউক্রেন আক্রমণের ফলে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়া কোভিড-১৯ সঙ্কট পরবর্তী সময়ে আমিরশাহির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।

ভোটের খেলা: ইউ এন এস সি বনাম ইউ এন জি এ

উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করলে রুশ পদক্ষেপের নিন্দা করে ইউ এন এস সি-র প্রস্তাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতদানে বিরত থাকার পদক্ষেপটি যথাযথ বলে মনে হয়। এ ছাড়াও এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে একাধিক তাৎক্ষণিক কারণ বর্তমান এবং সেগুলির মধ্যে একটি বড় অংশ জড়িত ইয়েমেনের হুতিকে একটি সন্ত্রাসবাদী সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য রুশ সমর্থন পাওয়া, যা আরব দেশটির উপরে হুতি-র রকেট হামলা চালানোর পরিণতি বলা চলে। ইউ এন এস সি ভোটে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতদানে বিরত থাকার পরে হুতিকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত না করার স্পষ্ট অবস্থান থেকে রাশিয়া সরে আসে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির এক মুখপাত্রের কথা অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরশাহিও নিজেকে নিবৃত্ত করেছে কারণ নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো প্রয়োগের ফলে সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি

যদিও এর অল্প কিছু সময় পরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ভোটে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং অন্য একাধিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশের মতোই রাশিয়ার বিরুদ্ধে মতদান করে। এ হেন অবস্থান পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার মতো একাধিক কারণ রয়েছে।

ইউ এন এস সি ভোটে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতদানে বিরত থাকার পরে হুতিকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত না করার স্পষ্ট অবস্থান থেকে রাশিয়া সরে আসে।

প্রথমত, ইউ এন জি এ আসলে ইউ এন এস সি-র মতো কর্তৃত্বমূলক নয়। ফলে একটি প্রভাবহীন ফোরামে মতদান করা সংযুক্ত আরব আমিরশাহি শ্রেয় বলে মনে করেছে। দ্বিতীয়ত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং অন্য আরব দেশগুলিকে ইউ এন জি এ ভোটে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে প্রভাবিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য রকমের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তৃতীয়ত, কয়েক জন বিশ্লেষকের মতে ইউ এন এস সি ভোটে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার ঘটনা বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার ফলে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তার অবস্থান বদলের সিদ্ধান্ত নেয়। চিনজিয়া বিয়াঙ্কোর মতে, এই অবস্থান বদলের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পারস্পরিক বিবাদ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (এবং অন্য আরব দেশগুলির) নিজেদের বাঁচিয়ে চলার প্রচেষ্টাকেই দর্শায়।

উপসংহার

সংযুক্ত আরব আমিরশাহি নানা ভাবে বুঝতে পেরেছে যে, নিজের অমিত অর্থনৈতিক (এবং সাম্প্রতিক কালে প্রতিরক্ষা) বলে বলীয়ান হয়ে একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে। ইউক্রেন সঙ্কট, যা কখনও চরম আকার ধারণ করবে না বলেই অনেকে মনে করেছিলেন, ভারত-সহ একাধিক বড় দেশের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাকে পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। রাশিয়ার বিরোধিতা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের সর্বাত্মক পদক্ষেপের (সামরিক পন্থা ব্যতীত) পরিপ্রেক্ষিতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির অবস্থানও ব্যতিক্রম নয়।

কোভিড-১৯ অতিমারির ফলে ঘটা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষিতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রধান, স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যটি হল নিজের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা। তাই সে রাশিয়াকে চটানোর সম্ভাব্য সকল পথ এড়িয়ে যেতে চায়। যদিও একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংযুক্ত আরব আমিরশাহির লক্ষ্যের পথে বর্তমান ইউক্রেন সঙ্কটের প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্য বনাম রাশিয়া লড়াই একাধিক চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরেছে। এ হেন একগুচ্ছ কারণই রাষ্ট্রপুঞ্জে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতদানে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

     
HADR

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ